ঢাকা,শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

কক্সবাজারে ৫০১৩ একর বনভূমি রোহিঙ্গার দখলে, বাড়ছে তাপমাত্রাও

বিশেষ প্রতিবেদক :: মিয়ানমারের রাখাইনে ২০১৭ সালের আগস্টে সহিংস ঘটনার পর মানবিক কারণে সীমানা খুলে দেয় বাংলাদেশ। এরপর ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। এর আগে থেকেই ৪ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছিল কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে। সব মিলিয়ে টেকনাফ-উখিয়ার সবুজ পাহাড়গুলো হয়ে ওঠে শুধুই রোহিঙ্গা ক্যাম্প।

বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হয় এ রোহিঙ্গাদের।

তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থ্যাগুলোর সমন্বয় গ্রুপ- আইএসসিজির সর্বশেষ হিসাব মতে, ৩৪টি ক্যাম্পে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৫ হাজার ৮২২ জন। কক্সবাজার বন বিভাগের হিসাবে ৫০১৩ একর বনভূমিতে রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে, এটা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপুল চাপে এ অঞ্চলে সংরক্ষিত বন এবং বন্যজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এত অল্প জায়গায় এত মানুষের ঘনত্ব ক্যাম্প ও তার আশপাশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে।

ঘনবসতিপূর্ণ এ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেখানে গড়ে উঠেছে সেটি বিপন্নপ্রায় প্রাণীদের সংরক্ষিত বন। ফলে, গুরুতরভাবে বিপর্যয়ে পড়েছে বিপন্ন এশিয়ান হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ। পাল্টে গেছে এ অঞ্চলের বাতাস ও ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা।

বনে এ ধ্বংসযজ্ঞ বন্যজীবন ও জীববৈচিত্র্যের কী পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করেছে তার ওপর একটি গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রিঙ্গার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের পাঁচ অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রশিদ, আতিকুল হক, তাসনিয়া আয়শা এশা, আতিকুর রহমান ও অলক পালের করা এ গবেষণাপত্রে তারা দেখিয়েছেন রোহিঙ্গাদের এই চাপ ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাতেও কতটা পরিবর্তন (এলএসটি) এনেছে।

এ গবেষণায় ল্যান্ডস্যাট ৮-এর ছবি ব্যবহার করে কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্প এবং সংলগ্ন অঞ্চলে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত উদ্ভিদের পরিবর্তনের পরিমাণ এবং এলএসটির পরিবর্তন পরীক্ষা করা হয়।

গবেষণায় বলা হয়েছে, কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্প অঞ্চলে প্রায় ১৮৭৬ হেক্টর বনভূমি কমেছে। গবেষণা অঞ্চলের এলএসটি অঞ্চলজুড়ে সর্বোচ্চ ৩৪.৪ থেকে ৩৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং বাতাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪.৪ থেকে ৩৭.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে স্থানিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বন ধ্বংসের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে, খুব দ্রুতই জায়গাটি বন্ধ্যা জমিতে পরিণত হয়ে যাবে এবং এলএসটিও বাড়বে। এসব কারণ শেষ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য হ্রাসকে ত্বরান্বিত করবে।

টেকনাফ-উখিয়ার এ অঞ্চলটি বিপন্ন এশিয়ান বন্যহাতির বিচরণক্ষেত্র। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারজুড়ে এশিয়ান হাতির সংখ্যা আনুমানিক ২৬৮টি। এরা গুমগুম করিডোর ধরে দুই দেশের বনে যাতায়াত করে। টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে হাতির যাতায়াতের এ পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের পর উজাড় হয়েছে পাঁচ হাজার একরের বেশি বনাঞ্চল। হাতি চলাচলের ১২টি করিডোর বন্ধ এবং ২২টিরও বেশি প্রাকৃতিক জলাধার ধ্বংস হয়েছে। বনাঞ্চল উজাড় করে ক্যাম্প তৈরির পর বন্যহাতির পাল সেখানে আটকা পড়েছে। জরিপ অনুসারে উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চলে ৬৭টি হাতি আছে।

ক্যাম্পের কারণে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চলে তিন বছর ধরে তীব্র খাদ্য ও পানি সংকটে রয়েছে এই বন্যহাতি। চলাচলের পথ বন্ধ হওয়ায় এর মধ্যে ৪০টি হাতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় আটকা পড়েছে। গত তিন বছরে বন্যহাতির আক্রমণে টেকনাফ ও উখিয়ায় মারা গেছে অন্তত ২৭ জন। এর মধ্যে ১৩ জনই রোহিঙ্গা।

গত তিন বছরে টেকনাফের বাহারছড়া ও উখিয়ার ইনানী বনাঞ্চলে রোগাক্রান্ত ও বিদ্যুৎস্পর্শ হয়ে মারা গেছে ৪টি হাতি। হাতির খাদ্য সংকট ঘোচাতে বন বিভাগ চলতি বছরে ৬০ হেক্টর সংরক্ষিত বন করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে তিনি জানান।

আইইউসিএনের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন চকরিয়া নিউজকে বলেন, হাতির যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্যাম্পে প্রায় দুইশবার হাতি ঢুকে পড়েছে। তাদের কর্মীরা এসব হাতি সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গাজী সৈয়দ মোহাম্মদ হাসমত চকরিয়া নিউজকে বলেন, পুরো এলাকাই হাতির বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। হাতি বড় প্রাণী। তার বসবাস, খাবার, বিশ্রাম, প্রজনন প্রভৃতির জন্য বড় এলাকার প্রয়োজন হয়। যেটা ওই এলাকায় একেবারেই নেই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দানেশ মিয়া চকরিয়া নিউজকে বলেন, হাতি বড় প্রাণী হওয়ায় আমরা এর চলাচল ও বিপন্নতা সহজেই দেখতে পাচ্ছি কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট গুঁইসাপ, সাপ, মেছোবাঘ, বানরসহ বিভিন্ন নিশাচর প্রাণীর জন্যও এলাকাটা ভয়াবহ হয়ে পড়ছে। গাছ কাটায় পাহাড় ধস হচ্ছে।

পাহাড়ে ২ লাখ লোকের বসতি : কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের লিংকরোড বন বিটের মনুরঘোনা এলাকার গহীন বনে হাতির অভয়ারণ্য ধ্বংস করে প্রায় ২৫ একর পাহাড় দখল করেছিল প্রভাবশালী চক্র। সেখানে দুই পাহাড়ের মধ্যে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হয়। গড়ে তোলে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির খামার।

প্রভাবশালীরা এ খামার করতে বনের ৫ হাজার গাছও কেটে সাবাড় করেছে। পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হলে সম্প্রতি জেলা প্রশাসন, বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথ অভিযান চালায়। বনের ২৫ একর ভূমি দখলমুক্ত করা হয়।

মনুরঘোনা এলাকার গহীন বনে হাতির অভয়ারণ্য ২৫ একর ভূমি দখলমুক্ত করা হলেও পুরো জেলায় এক লাখ একরের বেশি পাহাড়ি ভূমি অবৈধ দখলে রয়েছে। এসব পাহাড়ে ২ লাখ লোক বসতি গড়ে তুলেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে হাতি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। বনের গাছ সাবাড় করেছে অবৈধ দখলদাররা। তাদের উচ্ছেদে নেই কোনো অভিযান।

জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, বর্ষা মৌসুমে টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিলে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়। তবে এত বেশি লোক উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় তহবিল না থাকায় পরিচালিত হয় না কোনো অভিযান। এ সুযোগে নিত্যনতুন বসতবাড়ি গড়ে উঠছে পাহাড়ে।

কক্সবাজারের পরিবেশ কর্মী অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান চকরিয়া নিউজকে জানান, জেলার বিভিন্ন স্থানে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গারাও ব্যাপক হারে পাহাড় দখল করছে। পাহাড় কেটে তারা অবৈধ বসতি গড়ে তুলছে। বর্ষায় টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ের মাটি নরম হলে পাহাড় কাটা শুরু হয়। এ সময়ে পাহাড়ধসে মৃত্যুর আশঙ্কাও বেড়ে যায়।

তিনি জানান, গত ৫ বছরে কক্সবাজার জেলায় পাহাড়ধসের ঘটনায় শতাধিক লোকের প্রাণহানি হয়েছে। এরপরও থামছে না ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ও পাহাড় কাটা।

উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় বন বিভাগের পাহাড়ে ঘর তুলে বসবাস করছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। তাদের অনেকে পাহাড়ি এলাকায় চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জনবল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাবে তারা অসহায়। বনভূমি অবৈধ দখলকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেও তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

পাঠকের মতামত: